Saturday, July 16, 2011

এক টুকরো বাংলাদেশঃ আত্মোপলব্ধির মহড়া

আয়নাল চৌকিদারকে বুদ্ধিমানই বলতে হবে। বেচারা সারা জীবন বিয়ে করেনি। কেননা সে জানতো, যে রাজনীতির পথে পা বাড়িয়েছে, তার ভবিষ্যত কখোনো শুভ হবেনা। তার পরিষ্কার বক্তব্য- খামোখা একটা মেয়েকে বিধবা বানাতে রাজি নই। আমার জীবন রাস্তাঘাটেই শেষ হবে। হয়েছেও তাই। অকস্মাত এক সকালে শোনা গেল নিজ বাড়িতে আয়নাল চৌকিদার ব্রাশফায়ারে খুন।

মাটির রাস্তার পাশে সদ্য জেগে ওঠা আয়নাল চৌকিদারের সুরম্য কবরের পাশ দিয়ে রিক্সায় করে যাচ্ছি আর ভাবছি। প্রতাপশালী আয়নাল আজ পথিকের নিরব চাহনীর বস্তু, জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন। সন্ধ্যার এখনও ঘন্টাখানেক বাকি, তবু চারিদিকে অভুতপূর্ব নিরব। অনেকদিন পরে গ্রামে আসায় আরো বেশি নিরব লাগছে। প্রায় বছর দেড়েক তো হবেই। মৃদুমন্দ বাতাস গায়ে লাগছে। দুয়েকটি পাখির থেমে থেমে ডাক কানে আসছে। গ্রাম বাংলার নিবিড় সৌন্দর্য অনেকদিন পর মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছি। রিকশার খটখট আওয়াজ ছাড়া চারিদিকে আর কোন আওয়াজ নেই। মাঝে মধ্যে দুএকজন পথিক, বিপরিত দিক থেকে আসা দুএকটি সাইকেল চোখে পড়ছে।


আর একটু পরেই আমার বাড়ি। আর একটু অপেক্ষা। অনেক কথাই মনে পড়ে। এই আয়নাল চৌকিদার ছিল এলাকার সময়ের দাপুটে সর্বহারা নেতা। এই তো সেদিনের কথা- ছোট চাচা দূর থেকে দেখাতেন দুইজন সঙ্গি নিয়ে লুঙ্গি পরিহিত আয়নাল হেটে যাচ্ছে মেঠো পথ ধরে। পিছনে উঁচু হয়ে থাকা ওটাই অটোমেশিনগান। কয়েকলাখ টাকা নাকি দাম। কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা উৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। কখোনো মুখোমুখি হলে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করতো- কি মমিন, আছো কেমন, বাড়ির সবাই ভালো? চাচা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন, আমার ভাতিজা। আমি হা করে তাকিয়ে দেখতাম শ্মশ্রুমণ্ডিত অস্ত্রধারী আয়নাল চৌকিদারকে। অস্ত্র কোমড়ে নিয়ে কি ভাবলেশহীন পথচলা!

আয়নাল চৌকিদার সর্বহারা নেতা। এই সর্বহারার উত্থান কোত্থেকে? স্বাধীনতা পরবর্তী অস্ত্রবাজ সমাজতন্ত্রীদের হাতেই সর্বহারার উত্থান। বুর্জোয়া খতম করে 'সাম্য'প্রতিষ্ঠাকামীদের হাত ধরেই অসংখ্য জিয়া-কামরুল প্রতিষ্ঠিত হলো গ্রামে গ্রামে। কমিউনিস্টদের একটি অংশ সেই যে অস্ত্র ধরে প্রতিপক্ষ নিধনের কাজে নেমে গেল তার মাশুল আজো বাংলাদেশ দিচ্ছে। গ্রামগঞ্জের পনেরো বিশ বছরের ছেলেরা পর্যন্ত আজো সর্বহারাদের অন্ধকার জীবনের পথে পা বাড়াচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইনু মেননরা কি এই বিচ্যুত সমাজতন্ত্রীদের অস্ত্রবাজীর দায়ভার নিতে প্রস্তুত? প্রায়শই ঘটে যাওয়া গুপ্ত হত্যার রাজনীতির পুরোধা হিসেবে তারা কি নিজেদের পরিচয় দিতে রাজি?

এক আয়নালের কবর দেখে অনেক কথাই মনে পড়ছে, অনেক ক্ষোভ ঝড়ে পড়ছে। আবার মনেযোগ দিলাম সুনসান নিঃসর্গ দেখার কাজে। পরিচিত মুখের দেখা পাওয়া শুরু করলাম। বাড়ি এসে গেছি। খাল পার হলেই বাড়ি। এক অদ্ভুত শিহরণ।

০২.

আমাদের সামসুল হক মোবাইল কিনেছে । মাইকের মত বাজে। "সাথি তেরা পেয়ার হোতা হ্যায়"- এক ভদ্রমহিলার সুরেলা কণ্ঠে গাওয়া গানটি ওর মোবাইলে এ ক'দিন শুনতে শুনতে অনেকটা মুখস্ত হয়ে গেছে। বাড়ির সব ঘর থেকেই সহজেই শোনা যায় সামসুল হকের মোবাইলে কল এসেছে। অবশ্য সে এখনও ভালিউম কমানোর পণ্থা শিখে উঠতে পারেনি। নাম সেভ করতেও পারেনা, তবে গান বের করতে পারে।

বয়সে আমার পাচঁ-ছ বছরের ছোট, তবে সম্পর্কে চাচা। কি জন্য সে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকয় মোবাইল কিনেছে- জিজ্ঞেস করলে হাসে। রাত পেরিয়ে সকাল হতেই শুনলাম, সামসুল হক নাকি পাশের ঘরের রুবেল, ও বাড়ির আরো কয়েকজনের সাথে টমটম ভাড়া করে গিয়েছিল সেই দূরে, মেলায়, লটারী ধরতে। রাতের বেলা এত দূ. . র, আমি অবাক হই। মেলায় জমজমাট লটারী চলছে মাসব্যাপি। দশটাকার টিকেট কিনে ঢোকে , নগদ নগদ লটারীর ফলাফল। প্রথম পুরষ্কার হুণ্ডা। প্রতিদিন অসংখ্য সামসুল হক চকচকে হুন্ডার স্বপ্ন নিয়ে রাতের ঘুম হারাম করে দূর দূরান্ত থেকে টাকার থলে নিয়ে ছুটে যায় লটারী ধরতে। সকাল বেলা খালি হাতে ফেরে। অকস্মৎ খেয়াল করলাম, সেই জোক, সেই যে আবু ইসহাকের লেখা "জোঁক" গল্পের জোঁক, শক্ত করে সামসুল হকদের গা আকড়ে চুষে চুষে রক্ত খাচ্ছে- বোকারামগুলো কিছুই টের পাচ্ছেনা।

০৩.

মাটির রাস্তা পেরিয়ে হঠাৎ ইটের রাস্তা শুরু। ঝাকুনিতে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। ভ্যানে চড়ে নানাবাড়ি যাচ্ছি আর আলাপ চলছে ভ্যান চালকের সাথে। একটু একটু করে জীবনের কথা বলছে। বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে নাম স্বাক্ষর করতে পারে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে বড় মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত গিয়ে আর যায়না। - কি করবো বাবা, মেয়েটার মাথা ভাল ছিল, কিন্তু খরচে কুলিয়ে উঠতে পারিনা। প্রাইভেট পড়াতে গেলে মাসে অন্তত তিনশ টাকা দিতে হয়...। আমি মনে মনে হিসাব করি, সামসুল হকের সাড়ে পাচ হাজার টাকার মোবাইল বনাম এই পিতার তিনশত টাকা। হিসাব মেলেনা। তবে মাটির সাথে তাল মিলিয়ে ভ্যানের চাকাগুলো ঠিকই এগিয়ে যায় সামনে।

নানাবাড়ি বড় মামার ঘরে দুপুরের খাবার খেয়ে মোড়ায় বসে আছি দরজার কাছে। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল একটু আগে। রোদহীন আকাশ, হালকা বাতাস বইছে, ভালোই লাগছে।

কর্দমাক্ত উঠোন পেরিয়ে এক মহিলা ঘরে উঠেই মামিকে বললো "কেমন আছেন?" ভিক্ষুক কি না বুঝতে পারলামনা। হাসিমুখে মহিলা বলে চললেন, ...কয়েকবাড়ি ঘুরে এক ঘর থেকে কিছু ভাত সংগ্রহ করেছেন। সাতটি মেয়ে। ২টিকে বিয়ে দিয়েছেন, আরো পাঁচটির চারটিতে স্কুলে যায়। এখন বাড়ি ফিরলেই স্কুল ফেরত মেয়েগুলো মা বলে জড়িয়ে ধরবে, বলবে মা ভাত দাও। কেবল কিছু ভাত সংগ্রহ হয়েছে, আর কিছু ভাত আর কিছু তরকারী যদি সংগ্রহ হয় তাহলেই বাড়ির দিকে ফিরবেন।
সব ঘরে তো যাওয়া যায়না। মুণ্সিবাড়ি তার মামাবাড়ি। কিন্তু লজ্জায় সে বাড়ি যাননি। গেলে প্লেট ভর্তি ভাত পাবেন সত্য, কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধ আপনজনের কাছে হাত পাততে বাধা দেয়। তাদেরই তো খোঁজ নেবার কথা...।

মহিলা একটু নিশ্বাস ছাড়লেন। ঘরের সবার মধ্যে এক বিষাদের চাদর ছেয়ে গেল। মামি তখনই উঠে হাড়ির কাছে গেলেন ভাতের খবর নিতে। আমি স্থানু হয়ে বসে রইলাম।

মহিলা বলে চলছেন, সবগুলো মেয়ে, বোঝেনই তো, জামাকাপড় লাগে অনেক। চিন্তায় থাকি, কোত্থেকে যোগাড় করবো...। আমি শুনতে থাকি আর নিজের মধ্যে হারিয়ে যাই। ধোপদুরস্ত পোশাক পড়ে ফুলবাবু সেজে বসে আছি, আর গ্রাম বাংলার জনপদে অসংখ্য মানুষ পেটের দায়ে, লজ্জা নিবারণের চিন্তায় দিনগুলো পার করে দেয়। আমি মানবতার জন্য কতটুকু উপকারী, কি করতে পারলাম তাদের জন্য? মহিলার কথায় সম্বিত ফিরে পাই, ... জায়গা জমি যা ছিল কোনরকম চলে যেত, কিন্তু ওই বড় মিয়া আমার টিপসই নিল, ভিটা পর্যন্ত দখল করে বিশাল ঘর তুলছে, আমাকে একটা টাকাও দিলনা...। আমি আরেকবার শিহরিত হই। একটুকরো বাংলাদেশ আমার চোখের সামনে দুলে ওঠে।

Monday, September 29, 2008

ভদ্র মহিলাকে ফিরিয়ে দিতে হলো

টিউশনি করবা?
টিউশনি?
একটু ঘুম ঘুম ভাব আসছিল। রুমের ছিটকিনি দিয়ে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ দরাজায় নক। খুলতেই দেখি রাকিব। প্রথম প্রশ্নই ছিল টিউশনি করবো কিনা। হতচকিত হয়ে গেলাম কিছুটা।
কিসের টিউশনি?
- আরে এত জিজ্ঞেস করার কি আছে, করবা কিনা তাই বল। মিটিমিটি হাসছে রাকিব।
হ্যা করবো।
- আরবী পড়াতে হবে।
আরবী? ? ? ! ! ! আমি কি আলেম না মাদ্রাসার ছাত্র?
-সে তো আমার বিষয়। তুমি করালে সেটা ম্যানেজ করবো আমি।

রাকিব মাঝে মাঝেই আমার রুমে আসতো, সিঙ্গেল রুম। ইনকোর্সের আগে একসাথে ঘরোয়া পরিবেশে পড়তাম। ছোটবেলা ওর তেমন আরবী পড়া শেখার সুযোগ হয়নি। আমাকে মাঝে মাঝে পড়তে দেখে সে এসে আমার কাছ থেকে শুধরে নিত। ক্লাসমেট। কুরআন পড়বে জেনে আমিও সময় দিতে চিন্তা করতাম না। সেই সূত্রেই সে সম্ভবত আমার জন্য টিউশনি নিয়ে হাজির। হলে ওঠার পর থেকেই দেখছি ক্লাসমেটরা বিভিন্ন ধরণের টিউশনি করছে। কে তিন হাজার কে পাঁচ হাজার এইসব গল্প শুনতাম প্রায়শ। শুনতাম হলে না উঠলে আর টিউশনি না করলে ছাত্রজীবনের পূর্ণতা আসেনা। মাঝে মাঝেই মনে হত, টিউশনি একটা করালে মন্দ হয়না। একটি ছেলেকে নিজের মত করে শেখাব, আমার হাত ধরে ছেলেটি জ্ঞানের রাজত্বে অগ্রসর হবে, আমাকে স্যার বলবে (!), অন্যরকম এক অনুভুতি। সুতরাং অফার যখন একটা আসলোই টেস্ট কেস হিসেবে নিয়েই দেখি। হোক না আরবী- টিউশনির উদ্দেশ্য তো পূরণ হবে। ওরা না হয় ইংলিশ মিডিয়াম পড়ায়- আমি একটু ব্যাতিক্রম, অসুবিধা কোথায়।হ্যা, পড়াব।
-ও হলো আমার ফুফাতো ভাই। পাশে দাড়ানো একজনকে দেখিয়ে দিল। হ্যান্ডশেক করলাম। এতক্ষণ ওভাবে খেয়াল করিনি।
-পড়াতে হবে আমার ফুফাতো বোনকে। আমি হতচকিত হলাম। ও খেয়াল করলো। দুষ্টমির হাসি হাসলো। বললো
- আরে ফুফাতো বোন বিবাহিত, এক মেয়ে আছে কেজিতে পড়ে। থাকে শ্বশুর বাড়ি। কলাবাগানে বাসা। দুই তিন মাসের মধ্যেই আমেরিকায় চলে যাবেন। যাবার আগে কোরআন পড়াটা শুদ্ধ করে শিখে নিতে চাচ্ছেন। আমাকে বললেন, আমি সাথে সাথেই তোমার কথা বললাম। এটি কোন প্রচলিত টিউশনি না, বিশেষ একটি উপকার ধরে নিতে পার। হুজুরদের কাছে আপাতত পড়তে চাচ্ছেন না।
আমি একটু নিরব হয়ে গেলাম। মেয়ে টিউশনি করাবনা এটি আমার অনেক আগের সিদ্ধান্ত। সাংগঠনিকভাবেই বলা আছে কোন শপথের কর্মীর পক্ষে এডাল্ট মেয়ে টিউশনি করানোর সুযোগ নেই। কর্মী থাকাকালীন করালেও শপথ নিতে হলে মেয়ে টিউশনি ছাড়তে হবে। আর ইসলামের শ্বাশ্বত বিধান তো এটাই। সুতরাং . . .। মুহুর্তেই বিপরীত যুক্তিগুলো মাথায় আসতে লাগলো। সে তো মেয়ে নয়, মহিলা। এক সন্তানের মাতা। সুতরাং আমার অনেক বড়। একাতো পড়াবো না, পিচ্চিটা নিশ্চয়ই সাথে থাকবে। তাছাড়া শ্বশুর বাড়িতে থাকে- লোকজনের আনাগোনা থাকবে নিশ্চয়ই। অসুবিধা কোথায়। একটা উপকার করা হলো। - আসল কথা হচ্ছে, টিউশনির থ্রিলটা ছাড়তে মন চাচ্ছিলনা।
বললাম, ঠিক আছে, করাব।
- তাহলে আজকে বিকেলেই চল।
ও-কে।

----------------------------------------

বিকেলে চললাম কলাবাগানের দিকে। নিলক্ষেত পর্যন্ত হেঁটেই গেলাম। বাসে কলাবাগান নেমে আবার হাটা। একসময় পৌছলাম বাসায়। ভাড়া থাকেন, তবে ফার্নিচার দেখলেই বোঝা যায় বেশ ভালো সচ্ছল। ফুফাতো বোন এলেন। সাথে পিচ্চিটা। কথা হলো। তিনি আবার খুলে বললেন কেন তাড়াহুড়ো করে শিখতে চাচ্ছেন। আমেরিকায় সুযোগ পাবেননা ধরে নিয়েই যাওয়ার আগে শিখে নিতে চাচ্ছেন। ঠিক হলো আগামীকাল থেকেই পড়ানো শুরু করবো।

নাস্তা পানি সেরে ফিরতে ফিরতে ভাবছি- জীবনের প্রথম টিউশনি। তাও আবার মহিলা। যাই হোক আব্বা-মাকে জানানো যাবেনা শুরুতেই। টিউশনি করছি শুনলে বলবেন সময়টা পড়ালেখার পেছনে ব্যয় করতে পারনা। আল্লাহ যতটুকু স্বচ্ছলতা দিয়েছেন সেটা কাজে লাগাতে অসুবিধা কোথায়?বিবিধ ভাবনায় ডুবে হলে ফিরলাম।

02.

হলে ফিরে ভাবছি- আগামীকাল থেকে টিউশনি, নতুন অভিজ্ঞতা। কিন্তু অন্তরে রয়ে যাওয়া খুঁতখুঁতি যাচ্ছেই না। কোন মেয়েকে টিউশনি করাবোনা - এ সিদ্ধান্ত এতটাই প্রবলভাবে ভেতরে বিরাজ করছিল, তা যেন এখন উপলব্ধি করছিলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে- আমার অপরাধবোধ যেন তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি প্রশ্নবোধক সিদ্ধান্ত নিলাম অথচ কারো সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজন বোধ করলাম না।মাগরীবের পর হল সভাপতি হাবীব ভাইয়ের রুমে গেলাম। ব্যক্তিগত কথা বলার জন্য সময় চাইলাম। সময় দিলেন রাত সাড়ে দশটা।

যতটুকু মনে পড়ে রাতটি চন্দ্রালোকিত ছিল। হলের মাঠে পূর্ব নির্ধারিত সময়েই মুখোমুখি বসলাম দু'জন। হাবীব ভাইকে দারুন পছন্দ ছিল আমার। কিছু কিছু লোককে কেন যেন দেখলেই ভালো লাগে, সব কথা বলা যায়। অবশ্য এ অনুভুতি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তার একটি বিশেষত্ব ছিল, প্রত্যেকের সাথে কাস্টমাইজড আচরণ করতে পারতেন। হলে ওঠার পর আমার অনেক ব্যক্তিগত সমস্যাকেই তিনি সমাধান করে দিয়েছেন। হাবীব ভাইয়ের ব্যক্তিগত রূচিবোধ আমাকে বেশ আকৃষ্ট করতো। তিনি রুমে ঢুকে শার্ট খুললেই দেখতাম ধবধবে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি- যেন আজই কেনা। তখনই মনে পড়ে যেত রসূল সা. এর ওই অভ্যাসটি। রসূল সা. এতটাই উন্নত রূচির ছিলেন যে নিজ পাগড়ীর নিচের পরিধেয় টুপি যেন তেল চিটচিটে না হয় সে জন্য টুপির নিচে আবার পৃথক এক টুকরো কাপড় পড়তেন। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে ওই কাপড়ের টুকরোকেও কেউ কখোনো ময়লা হতে দেখেনি। আজকের রসূল প্রেমিক অনেককেই দেখা যায়- পাঞ্জাবীর পশ্চাত অংশ ক্যালেন্ডারের পাতার মত মুড়িয়ে উঠে আছে, ময়লা আর বিবর্ণ পাগড়ি যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগের, আর পানসিক্ত দাতঁ? সে কথা বলাই বাহুল্য। তবু তারা রসূল প্রেমীক। অথচ রসূল সা. মুখ খুললেই দাঁতগুলো মুক্তোর মত ঝিলিক দিয়ে উঠতো। আসলে সবই অশিক্ষার ফসল।

হাবীব ভাইকে সব কথা বললাম। বললাম, দায়িত্বশীল হিসেবে আপনার পরামর্শ নিয়েই অগ্রসর হতে চাই। তিনি মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। বললেন, মেয়েদেরকে ব্যক্তিগত টিউশনির ব্যাপারে সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গি তো তুমিই উল্লেখ করলে। আর আল্লাহর রসূলের (সা.) নির্দেশনা তো আমাদের সামনে রাখাই উচিত। যদিও ভদ্রমহিলা তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, তথাপি, ইসলামী আন্দোলনের একজন শপথের কর্মী হিসেবে অধিক স্বচ্ছ থাকাই তো তোমার কাছে সময়ের দাবী। আসলে তোমার যা পারিবারিক অবস্থা, তাতে টিউশনি তো তোমার জন্য জরুরী নয়। ভীষণ আর্থিক সমস্যা হত, তাও না হয় একটা বিবেচনা করা যেত। অতএব. . . একটা হাসি দিলেন, বললেন, তোমার সেখানে 'না' করে দেওয়াটাই মনে হয় ভালো হয়। - মুহুর্তেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। ধন্যবাদ জানালাম হাবীব ভাইকে। ততক্ষণে রাত সাড়ে এগারোটা। রুমে গিয়ে প্যাড আর কলম হাতে নিলাম, লিখতে বসলাম। রূমমেট অন্ধ। সুতরাং, বাতি জ্বললেই কি আর নিভলেই কি। খসখস কলম এগিয়ে চললো-

শ্রদ্ধেয়া আপা,
. . .
. . .
অনেকটা উৎসাহ নিয়েই আপনাকে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল, আপনার কুরআন শেখার অগ্রযাত্রায় আমি একজন সক্রিয় সহযোগী হব। কিন্তু কাল আপনার বাসা থেকে বিদায় নেবার পর অনেক ভেবে দেখলাম, যে কুরআন সেখানোর জন্য আমি আপনার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলাম, সে কুরআনেরই দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে- একাকী একজন নারীকে পড়ানো আমার জন্য বৈধ নয়। অতএব, কুরআন পড়াতে এসে কুরআনের নির্দেশের প্রতি অবজ্ঞা করি- আপনি নিশ্চয়ই এমনটি চাইবেননা।

একজন শ্রদ্ধেয়া আপা হিসেবে আমার এ খেয়ালী আচরণকে ক্ষমা করবেন, এ আমার প্রত্যাশা। আমি আশা করি, আমার এ প্রত্যাখ্যান আপনার কুরআন শিক্ষার ক্ষেত্রে মোটেই বাধা হবেনা। অনুরোধ থাকবে সত্তর একজন বয়স্ক আলেম রেখে কিংবা কোন মহিলা আলেমের মাধ্যমে আপনার শুভ উদ্যোগকে অব্যহত রাখবেন।
আপনার ছোটভাই
. . .।

সকালে রাকিবের হাতে চিঠিটি দিয়ে বললাম, পড়। ইনভেলাপ খুলে ও এক নিশ্বাসে পড়লো। আমি যতটা গুরুত্ব দিয়েছিলাম, আমার অপারগতাকে সম্ভবত ও ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করলোনা। তবু আমার মতামত কে সম্মান জানিয়ে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলোনা। বললাম আজকে বিকেলেই দয়া করে চিঠিটি পৌঁছে দিও।

------------------------------

ক' বছর আগের কথা, এরপর বেশ কিছুদিন রাকিব আমাকে খুঁচিয়েছে। তোমার ছাত্রী আমেরিকা চলে গেছে, সে কিন্তু আর কোন হুজুরের কাছে শেখেনি। হু, সব দোষ তোমার। আমি শুনতাম আর হাসতাম।

ভদ্রমহিলাকে ফিরিয়েই দিতে হয়েছিল। অবশ্য টিউশনির শখ পুরণ হয়েছিল বছর দুয়েক পরে।

Tuesday, August 19, 2008

সময়ের সাথে পথচলা

রেজিস্ট্রেশন করলাম। আসলে বিভিন্ন ব্লগে রেগুলারিটি মেইনটেইন করা আমার জন্য সহজ হবেনা। ব্যাক্তিগত বহুবিধ ব্যস্ততা ইত্যাদি অন্তরায় হবে। এছাড়া এখানে সরাসরি বাংলায় লেখার পন্থা দেখতে পাচ্ছিনা। তথাপি রেজিস্ট্রেশন করলাম। দেখি কতদূর নিয়ে যেতে পারি। শুভেচ্ছা সবাইকে।