Saturday, July 16, 2011

এক টুকরো বাংলাদেশঃ আত্মোপলব্ধির মহড়া

আয়নাল চৌকিদারকে বুদ্ধিমানই বলতে হবে। বেচারা সারা জীবন বিয়ে করেনি। কেননা সে জানতো, যে রাজনীতির পথে পা বাড়িয়েছে, তার ভবিষ্যত কখোনো শুভ হবেনা। তার পরিষ্কার বক্তব্য- খামোখা একটা মেয়েকে বিধবা বানাতে রাজি নই। আমার জীবন রাস্তাঘাটেই শেষ হবে। হয়েছেও তাই। অকস্মাত এক সকালে শোনা গেল নিজ বাড়িতে আয়নাল চৌকিদার ব্রাশফায়ারে খুন।

মাটির রাস্তার পাশে সদ্য জেগে ওঠা আয়নাল চৌকিদারের সুরম্য কবরের পাশ দিয়ে রিক্সায় করে যাচ্ছি আর ভাবছি। প্রতাপশালী আয়নাল আজ পথিকের নিরব চাহনীর বস্তু, জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন। সন্ধ্যার এখনও ঘন্টাখানেক বাকি, তবু চারিদিকে অভুতপূর্ব নিরব। অনেকদিন পরে গ্রামে আসায় আরো বেশি নিরব লাগছে। প্রায় বছর দেড়েক তো হবেই। মৃদুমন্দ বাতাস গায়ে লাগছে। দুয়েকটি পাখির থেমে থেমে ডাক কানে আসছে। গ্রাম বাংলার নিবিড় সৌন্দর্য অনেকদিন পর মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছি। রিকশার খটখট আওয়াজ ছাড়া চারিদিকে আর কোন আওয়াজ নেই। মাঝে মধ্যে দুএকজন পথিক, বিপরিত দিক থেকে আসা দুএকটি সাইকেল চোখে পড়ছে।


আর একটু পরেই আমার বাড়ি। আর একটু অপেক্ষা। অনেক কথাই মনে পড়ে। এই আয়নাল চৌকিদার ছিল এলাকার সময়ের দাপুটে সর্বহারা নেতা। এই তো সেদিনের কথা- ছোট চাচা দূর থেকে দেখাতেন দুইজন সঙ্গি নিয়ে লুঙ্গি পরিহিত আয়নাল হেটে যাচ্ছে মেঠো পথ ধরে। পিছনে উঁচু হয়ে থাকা ওটাই অটোমেশিনগান। কয়েকলাখ টাকা নাকি দাম। কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা উৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। কখোনো মুখোমুখি হলে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করতো- কি মমিন, আছো কেমন, বাড়ির সবাই ভালো? চাচা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন, আমার ভাতিজা। আমি হা করে তাকিয়ে দেখতাম শ্মশ্রুমণ্ডিত অস্ত্রধারী আয়নাল চৌকিদারকে। অস্ত্র কোমড়ে নিয়ে কি ভাবলেশহীন পথচলা!

আয়নাল চৌকিদার সর্বহারা নেতা। এই সর্বহারার উত্থান কোত্থেকে? স্বাধীনতা পরবর্তী অস্ত্রবাজ সমাজতন্ত্রীদের হাতেই সর্বহারার উত্থান। বুর্জোয়া খতম করে 'সাম্য'প্রতিষ্ঠাকামীদের হাত ধরেই অসংখ্য জিয়া-কামরুল প্রতিষ্ঠিত হলো গ্রামে গ্রামে। কমিউনিস্টদের একটি অংশ সেই যে অস্ত্র ধরে প্রতিপক্ষ নিধনের কাজে নেমে গেল তার মাশুল আজো বাংলাদেশ দিচ্ছে। গ্রামগঞ্জের পনেরো বিশ বছরের ছেলেরা পর্যন্ত আজো সর্বহারাদের অন্ধকার জীবনের পথে পা বাড়াচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইনু মেননরা কি এই বিচ্যুত সমাজতন্ত্রীদের অস্ত্রবাজীর দায়ভার নিতে প্রস্তুত? প্রায়শই ঘটে যাওয়া গুপ্ত হত্যার রাজনীতির পুরোধা হিসেবে তারা কি নিজেদের পরিচয় দিতে রাজি?

এক আয়নালের কবর দেখে অনেক কথাই মনে পড়ছে, অনেক ক্ষোভ ঝড়ে পড়ছে। আবার মনেযোগ দিলাম সুনসান নিঃসর্গ দেখার কাজে। পরিচিত মুখের দেখা পাওয়া শুরু করলাম। বাড়ি এসে গেছি। খাল পার হলেই বাড়ি। এক অদ্ভুত শিহরণ।

০২.

আমাদের সামসুল হক মোবাইল কিনেছে । মাইকের মত বাজে। "সাথি তেরা পেয়ার হোতা হ্যায়"- এক ভদ্রমহিলার সুরেলা কণ্ঠে গাওয়া গানটি ওর মোবাইলে এ ক'দিন শুনতে শুনতে অনেকটা মুখস্ত হয়ে গেছে। বাড়ির সব ঘর থেকেই সহজেই শোনা যায় সামসুল হকের মোবাইলে কল এসেছে। অবশ্য সে এখনও ভালিউম কমানোর পণ্থা শিখে উঠতে পারেনি। নাম সেভ করতেও পারেনা, তবে গান বের করতে পারে।

বয়সে আমার পাচঁ-ছ বছরের ছোট, তবে সম্পর্কে চাচা। কি জন্য সে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকয় মোবাইল কিনেছে- জিজ্ঞেস করলে হাসে। রাত পেরিয়ে সকাল হতেই শুনলাম, সামসুল হক নাকি পাশের ঘরের রুবেল, ও বাড়ির আরো কয়েকজনের সাথে টমটম ভাড়া করে গিয়েছিল সেই দূরে, মেলায়, লটারী ধরতে। রাতের বেলা এত দূ. . র, আমি অবাক হই। মেলায় জমজমাট লটারী চলছে মাসব্যাপি। দশটাকার টিকেট কিনে ঢোকে , নগদ নগদ লটারীর ফলাফল। প্রথম পুরষ্কার হুণ্ডা। প্রতিদিন অসংখ্য সামসুল হক চকচকে হুন্ডার স্বপ্ন নিয়ে রাতের ঘুম হারাম করে দূর দূরান্ত থেকে টাকার থলে নিয়ে ছুটে যায় লটারী ধরতে। সকাল বেলা খালি হাতে ফেরে। অকস্মৎ খেয়াল করলাম, সেই জোক, সেই যে আবু ইসহাকের লেখা "জোঁক" গল্পের জোঁক, শক্ত করে সামসুল হকদের গা আকড়ে চুষে চুষে রক্ত খাচ্ছে- বোকারামগুলো কিছুই টের পাচ্ছেনা।

০৩.

মাটির রাস্তা পেরিয়ে হঠাৎ ইটের রাস্তা শুরু। ঝাকুনিতে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। ভ্যানে চড়ে নানাবাড়ি যাচ্ছি আর আলাপ চলছে ভ্যান চালকের সাথে। একটু একটু করে জীবনের কথা বলছে। বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে নাম স্বাক্ষর করতে পারে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে বড় মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত গিয়ে আর যায়না। - কি করবো বাবা, মেয়েটার মাথা ভাল ছিল, কিন্তু খরচে কুলিয়ে উঠতে পারিনা। প্রাইভেট পড়াতে গেলে মাসে অন্তত তিনশ টাকা দিতে হয়...। আমি মনে মনে হিসাব করি, সামসুল হকের সাড়ে পাচ হাজার টাকার মোবাইল বনাম এই পিতার তিনশত টাকা। হিসাব মেলেনা। তবে মাটির সাথে তাল মিলিয়ে ভ্যানের চাকাগুলো ঠিকই এগিয়ে যায় সামনে।

নানাবাড়ি বড় মামার ঘরে দুপুরের খাবার খেয়ে মোড়ায় বসে আছি দরজার কাছে। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল একটু আগে। রোদহীন আকাশ, হালকা বাতাস বইছে, ভালোই লাগছে।

কর্দমাক্ত উঠোন পেরিয়ে এক মহিলা ঘরে উঠেই মামিকে বললো "কেমন আছেন?" ভিক্ষুক কি না বুঝতে পারলামনা। হাসিমুখে মহিলা বলে চললেন, ...কয়েকবাড়ি ঘুরে এক ঘর থেকে কিছু ভাত সংগ্রহ করেছেন। সাতটি মেয়ে। ২টিকে বিয়ে দিয়েছেন, আরো পাঁচটির চারটিতে স্কুলে যায়। এখন বাড়ি ফিরলেই স্কুল ফেরত মেয়েগুলো মা বলে জড়িয়ে ধরবে, বলবে মা ভাত দাও। কেবল কিছু ভাত সংগ্রহ হয়েছে, আর কিছু ভাত আর কিছু তরকারী যদি সংগ্রহ হয় তাহলেই বাড়ির দিকে ফিরবেন।
সব ঘরে তো যাওয়া যায়না। মুণ্সিবাড়ি তার মামাবাড়ি। কিন্তু লজ্জায় সে বাড়ি যাননি। গেলে প্লেট ভর্তি ভাত পাবেন সত্য, কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধ আপনজনের কাছে হাত পাততে বাধা দেয়। তাদেরই তো খোঁজ নেবার কথা...।

মহিলা একটু নিশ্বাস ছাড়লেন। ঘরের সবার মধ্যে এক বিষাদের চাদর ছেয়ে গেল। মামি তখনই উঠে হাড়ির কাছে গেলেন ভাতের খবর নিতে। আমি স্থানু হয়ে বসে রইলাম।

মহিলা বলে চলছেন, সবগুলো মেয়ে, বোঝেনই তো, জামাকাপড় লাগে অনেক। চিন্তায় থাকি, কোত্থেকে যোগাড় করবো...। আমি শুনতে থাকি আর নিজের মধ্যে হারিয়ে যাই। ধোপদুরস্ত পোশাক পড়ে ফুলবাবু সেজে বসে আছি, আর গ্রাম বাংলার জনপদে অসংখ্য মানুষ পেটের দায়ে, লজ্জা নিবারণের চিন্তায় দিনগুলো পার করে দেয়। আমি মানবতার জন্য কতটুকু উপকারী, কি করতে পারলাম তাদের জন্য? মহিলার কথায় সম্বিত ফিরে পাই, ... জায়গা জমি যা ছিল কোনরকম চলে যেত, কিন্তু ওই বড় মিয়া আমার টিপসই নিল, ভিটা পর্যন্ত দখল করে বিশাল ঘর তুলছে, আমাকে একটা টাকাও দিলনা...। আমি আরেকবার শিহরিত হই। একটুকরো বাংলাদেশ আমার চোখের সামনে দুলে ওঠে।

No comments: